মাথিনের কূপ (আমার সাগরপারে কাব্যের অংশ বিশেষ)
মোঃ নুরুল ইসলাম
[বড়বাড়িয়া, বাগেরহাট ৪ ঠা চৈত্র, ১৪২২ (১৮ই মার্চ, ২০১৬) শুক্রবার]
মাথিনের কূপ |
কক্সবাজার হতে ছিয়াশি কিলোমিটার দূরত্বে টেকনাফ
কূলেতে তার বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে যে নদী নাফ,
বণিকেরা মিলে আনিত সেকালে এ বন্দরে কত মালামাল
মৎস্য তামাক কাষ্ঠ বার্মা থেকেও বাংলায় আসিতো চাল।।
জনবসতি আছিল যেমতি রাখাইন তার সংখ্যাগুরু গোত্র
বাণিজ্য নিরাপত্তা দিতে নিশ্চয়তা পুলিশ ফাঁড়ী বসায় অত্র,
টেকনাফ তখন ছিল বিলক্ষণ দুর্গম বানিজ্যিক এলাকা বটে
কর্তৃপক্ষীয় বৈরিতার ফলে ধীরাজের আগমন হেথায় ঘটে।
এমতি দূরে বদলির ব্যাখ্যা মিলে তার স্বীকারোক্তিতে
‘যখন পুলিশ ছিলাম’ উপন্যাসে, ব্যর্থ হন গুপ্তচর বৃত্তিতে,
আদেশ তার ‘পরে সরকার বিরোধী বিপ্লবী বাঙ্গালী ধরিতে
এমনি এক বিপ্লবী ধরিতে না পারার অপরাধে বদলি দূরান্তে।
বিংশ শতক শুরুতে কলকাতা হতে শাস্তির পদায়ন চট্টলায়
বিড়ম্বনা হেথায় স্বীয় অবয়ব তথা সুন্দরী ললনা দুর্বলতায়,
চোখে জায়ার পড়লে এবার তদীয় পদস্থ ব্রিটিশ অধিকর্তার
সাজা আরোপিত উপরে তার টেকনাফ ফাঁড়ীতে স্থানান্তর।
কলকাতার পর চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র নগর, টেকনাফে কি ভরসা!
জলের মাছ ডাঙ্গায় তোলা সম কলকাতাবাসী ধীরাজের দশা,
সমকালে টেকনাফ চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন গ্রামের মতোন
বিরল বাঙালি অধ্যুষিত তলাটে মগ সংস্কৃতি ধীরাজের নূতন।
ক্ষুদ্র পরিসরে বৃদ্ধ পিতামাতার দশা ভরে ধীরাজের দিলে
কর্মতাড়া বিহনে দূর প্রবাসে স্মৃতি রোমন্থন শুধুই বিরলে,
চায়ের পেয়ালা হাতে ফাঁড়ীর অলিন্দে কালক্ষয় দুশ্চিন্তায়
চত্বরের সুপেয় এক কূপের জল নিতে কত মগ দুহিতায়।
একদা ধীরাজের নিদ ভাঙে সুমধুর মগ তরুণী কলগুঞ্জনে
কূপ ঘিরে বসে মত্ত হাস্যরসে অর্ধশতাধিক তরুণী আনমনে
ধীরাজ দেখে বারান্দায় এসে বালি-কলতানে অঙ্গণ মুখরিত,
কূপের জল তুলে তরুণীদল সে দৃশ্য ধীরাজের মনে ধরিত।
ওরা আসিতো জলকে এমনি রকমারি পোশাকে প্রতিদিন
একদিন সে নিরখে পরমা সুন্দরী তরুণী কী অবয়ব শালীন!
বাঙালি ললনা সম অপরূপ মুখচ্ছবি চিত্র নায়িকাও হারে
অপলক নেত্রে ধীরাজ সম্ভাষে সাদরে মনের মানুষ তারে।।
কী স্নিগ্ধ রূপে বিমুগ্ধ কার আদরের দুলালীর রূপলাবণ্য!
অয়াংথিন প্রতাপশালী রাখাইন জমিদার এলাকায় বরেণ্য
একমাত্র কন্যা তার, হরিলে হৃদিমন্দির পরদেশী ধীরাজের
প্রতীক্ষা কেবলি এলো কি রূপসি মিটাতে তৃষা পেমের!
এমতি শরদিন্দু-নিভাননা মাথিনকে ধীরাজের ধরে চোখে
মন দেয়া-নেয়া চলে জলকে ছলে আড়ে আড়ে অলখে,
গাঢ় হলে সম্পর্ক প্রেমের, একদিন দেখিলো আলোর মুখ
এ নিয়ে হল কত কানঘুষা, ফিসফিসানি, আলোচনা প্রমুখ।
শেষে ঘটে পরিবারের কানে উঠে অসম এপ্রেম পিরিতি
বাধা সত্ত্বেও হয় পাকাপাকি বিয়ে হবে মেনে সমাজ-রীতি
কনে পরিবার সবে ধন নীলমণি কন্যার প্রেমে দিলে স্বীকৃতি
সাধিলে বাধ ধীরাজের পৈতৃক ধর্ম তথা রক্ষণশীল প্রকৃতি।
গড়ায়নি পরিণামে ধীরাজ-মাথিন অসম প্রেম বিবাহ বন্ধে
ধর্মীয় প্রতিকূলতা ধীরাজের রক্ষণশীল পারিবারিক দ্বন্দ্বে,
কলকাতাবাসী পিতা দিলেন তারবার্তা য় ধীরাজে আদেশ
অবিলম্বে ফিরে যেতে সেথায় ত্যজি টেকনাফ দূরদেশ।
পিতৃ আদেশে ধীরাজ গেলে চলে, না বলে মাথিনে
ধুঁকে ধুঁকে বিরহবিদুর মাথিন বিলাপে, ধীরাজ বিহনেঃ
মাথিনের বিলাপ (গীতি)
পরদেশী বন্ধু রে তুমি মোর মন হরিয়া
একেলা ফেলে কেমনে গেলে চলিয়া।
তোমা পন্থ পানে চেয়ে চেয়ে মোর আঁখি হলো ঘোর
মনঃপ্রাণ সবই সঁপিলাম তোমা চরণে হইয়া বিভোর
থাকিতে এ জীবন পাব কি দেখা ওগো প্রাণসখা মোর!
আর কত কাঁদিব তোমা লাগি হেথায় বসিয়া -------
পরদেশী বন্ধু রে তুমি মোর মন হরিয়া
একেলা ফেলে কেমনে গেলে চলিয়া।
না জানি আমি অবলা কত দূরে কলকাতা!
কত দিনে ফিরিবে তুমি মোর পানে এথা,
ত্যজিনু আহার নিদ সকলই তোমা লাগিয়া -------
পরদেশী বন্ধু রে তুমি মোর মন হরিয়া
একেলা ফেলে কেমনে গেলে চলিয়া।
* * * *
বাপে কান্দে মায়ও কান্দে, কান্দে পাড়াপড়শি
আহার হস্তে কান্দে সবে অভাগিনীর পাশে বসি
উঠে না ত মুখেতে মোর কেমনে আহার করি!
দেখি আহারেতে তুমি আছ মোর পানে চাহিয়া -------
পরদেশী বন্ধু রে তুমি মোর মন হরিয়া
একেলা ফেলে কেমনে গেলে চলিয়া।
মোরে পিরিতি শিখাইয়া কোথায় গেলে লুকাইয়া
দিন কাটে ত রাত কাটে না রাখিছ পিরিতে মজাইয়া
কি হাল হয়েছে মোর একবার নয়নেতে দেখ আসিয়া ---
পরদেশী বন্ধু রে তুমি মোর মন হরিয়া
একেলা ফেলে কেমনে গেলে চলিয়া।
আসিবে কি দিন আগের মত মোরা পাশাপাশি দুজনে
কহিব মনের যত জমানো কথা তোমায় বসিয়া বিজনে!
এমনি পিরিতি শিখাইলে জাতি কুল মান সবই হরিলে
বাকি আছে এখনও প্রাণ, দিব তাও তোমায়, চাহিলে!
মোরে যাও সাথে নিয়া ওরে নিঠুরিয়া -------
পরদেশী বন্ধু রে তুমি মোর মন হরিয়া
একেলা ফেলে কেমনে গেলে চলিয়া।
যদি না আস ফিরিয়া এ বিরহিণী কেঁদে কেঁদে যাবে মরিয়া
তুমি মোর মরণ খবর-- পাবে একদিন দূরদেশেতে বসিয়া
কি হবে আর মোর---- তুমি বিনে এ জীবনে বাঁচিয়া ----
পরদেশী বন্ধু রে তুমি মোর মন হরিয়া
একেলা ফেলে কেমনে গেলে চলিয়া।
এরূপ বিলাপ করিতে করিতে বিরহিণী দূরদেশী বন্ধু লাগিয়া
অন্নজল ত্যাগী শয্যাশায়ী মাথিনের প্রাণপাখি গেলো উড়িয়া,
টেকনাফ থানা চত্বরে বিয়োগান্ত প্রেম সিক্ত যে কূপের অবস্থান
মাথিনের কূপ খ্যাত , শতাব্দী পুরানো কাহিনিচিত্র দর্শনীয় স্থান।
এমনি বিরল প্রেমের সাক্ষী টেকনাফ থানার ঐতিহাসিক কূপ
কোমল মতি রাখাইন কন্যার প্রাণহারী প্রেমের কালজয়ী রূপ,
ভিড়ে হেথা দরশনে দেশবিদেশের কত পরিব্রাজক অতিথি
দূর অজানা লোকে বসে নিরখে মাথিন তার করুণ প্রেম-স্মৃতি। ৯৪
[সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @মোঃ নুরুল ইসলাম]
No comments